আজ ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, অর্থনীতিবিদ, সাবেক আমলা এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খানের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। আকবর আলি খানের সাথে তাঁর জীবনের শেষ প্রায় পাঁচটি বছর আমার কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল। তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্কুলে প্রফেসর (অধ্যাপক) হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়টি ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁর সাথে কাজ করার জন্য আমাকে টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট (শিক্ষকতা সহকারী) হিসেবে নিয়োগ করে। চাকরিতে যোগদানের দিন সকাল ৯টায় আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রিপোর্ট করতে বলা হয়েছিল। আমি তখনো জানতাম না কোন প্রফেসরের সাথে আমাকে যুক্ত করা হতে পারে। বিজনেস স্কুলের কো-অর্ডিনেশন অফিসে যাওয়ার পর আমাকে বলা হলো আপনি আকবর আলি খানের সাথে কাজ করবেন এবং তিনি কিছুক্ষণের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন। কথাটি শোনার পর একই সাথে আমার আনন্দ এবং ভয় কাজ করতে লাগলো। আমি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ২০১৭ সালে গ্রাজুয়েশন শেষ করেছিলাম এবং ২০১৫ সালে আকবর আলি খানের অধীনে একটি কোর্স (বিজনেস এনভায়রনমেন্ট) করেছিলাম। তাঁকে আমরা সবাই খুব ভয় পেলেও অত্যন্ত সম্মান করতাম। আকবর আলি খান ১০টার কিছু পরে অফিসে আসলেন। আমি স্যারকে সালাম দিয়ে বললাম আপনার নতুন শিক্ষকতা সহকারী হিসেবে আমাকে নিযুক্ত করা হয়েছে। স্যার বললেন, ভেরি গুড। কিন্তু আমার সাথে কোন শিক্ষকতা সহকারীই বেশিদিন কাজ করে না। কোন কারণে তারা চলে যায়। ঠিক কি কারণে চলে যায় আমি জানি না। আপনি কতদিন থাকবেন? আমি তখন কিছু না বললেও পরবর্তীতে আকবর আলি খানের সাথে তাঁর জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আমার কাজ করা হয়।
আকবর আলি খান ব্র্যাক বিজনেস স্কুলের বিবিএ ও এমবিএ প্রোগ্রামে বিজনেস এনভায়রনমেন্ট (ব্যবসায় পরিবেশ) এবং এক্সিকিউটিভ এমবিএ প্রোগ্রামে করপোরেট গভর্নেন্স অ্যান্ড সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি (করপোরেট শাসন এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা) পড়াতেন। তিনি কিছুদিন এমবিএ প্রোগ্রামে হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্টও (মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা) পড়িয়েছিলেন। একবার কৌতুহলবশত স্যারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম তিনি অর্থনীতিবিদ হয়েও অর্থনীতির কোর্স না পড়িয়ে কেন ব্যবসায় প্রশাসনের কোর্স পড়ান (আকবর আলি খানের কাছে মাঝে মধ্যেই অর্থনীতি ডিপার্টমেন্ট থেকে কোর্স পড়ানোর অনুরোধ আসত)। তিনি উত্তরে বলেছিলেন, তাঁর ব্যবসায় প্রশাসনে ডিগ্রি না থাকলেও সুদীর্ঘ কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি ব্যবসায় প্রশাসনের অনেক কোর্স খুব দক্ষতা এবং আগ্রহের সাথেই পড়াতে পারেন।
সত্যিকার অর্থেই আকবর আলি খানের কর্মজীবন ছিল বিচিত্র অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ। তিনি শিক্ষক হতে চেয়েছিলেন। কানাডায় অর্থনীতি পড়ার পূর্বে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন। তিনি অনার্স (১৯৬৪) এবং মাস্টার্স (১৯৬৫) দুটোতেই প্রথম শ্রেণিতে প্রথম ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে আবেদন করেছিলেন কিন্তু সিএসএস (সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিসেস) পরীক্ষার আবেদনপত্র জমা দেয়ায় তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ দেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে তিনি এক বছরের মত পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল ও কারিগরী বিশ্ববিদ্যালয়ে (বর্তমান বুয়েট) ওয়ার্ল্ড সিভিলাইজেশন (বিশ্বসভ্যতা) পড়িয়েছিলেন। তারপর তিনি সিএসএস পরীক্ষা দিয়ে ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে চলে যান। এক বছর লাহোরের সিভিল সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর ১৯৬৮ সালে তাকে রাজশাহী জেলার শিক্ষানবিশ কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে ১৯৬৯ সালে এসডিও (সাব-ডিভিশনাল অফিসার) হিসেবে তার কর্মস্থল হয় হবিগঞ্জে। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে (ধারাবাহিকভাবে) তিনি সংস্থাপন মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সরকারী কর্মকমিশন সচিবালয়, ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস (ইকোনমিক মিনিস্টার), অর্থ মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন। ১৯৯৩ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকারের সচিব হিসাবে পদোন্নতি লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৯৬ সালে অর্থ সচিব হিসাবে দায়িত্ব পান। ২০০১ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব পদে পদোন্নতি দেন এবং এ পদ থেকেই তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যান। পরবর্তীতে তিনি ওয়াশিংটনে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসাবে অল্টারনেটিভ এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর (বিকল্প কার্যনির্বাহী পরিচালক) পদে কাজ করেন। দেশে ফিরে এসে ২০০৬ সালে তিনি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ইয়াজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন সরকারের অর্থ, পরিকল্পনা, বাণিজ্য, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন। যদিও কিছুদিন পরেই তিনি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে প্রতিবন্ধকতা দেখিয়ে উপদেষ্টা পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ২০০৭ সালে সরকার আকবর আলি খানকে চেয়ারম্যান করে রেগুলেটরি রিফর্মস কমিশন গঠন করে এবং সেখানে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
আকবর আলি খান ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২৭ বছর এবং তিনি এসডিও (সাব-ডিভিশনাল অফিসার) হিসেবে হবিগঞ্জে কর্মরত ছিলেন। তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে (প্রথম খণ্ড) মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কথা বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে তিনি নিজ হাতে লিখিত আদেশ তৈরি করে হবিগঞ্জ আনসারের অস্ত্র মুক্তিবাহিনীকে দেওয়ার আদেশ দেন। সরকারি খাদ্যগুদাম থেকে মুক্তিবাহিনীর জন্য বিনামূল্যে চাল, গম এবং চিনি বরাদ্দ করেন। একই সাথে তিনি সরকারি কর্মচারীদের তিন মাসের বেতন অগ্রিম প্রদানের নির্দেশ দেন। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য তহবিল তৈরি করতে ব্যাংকের ভল্ট থেকে প্রায় তিন কোটি টাকা উঠিয়ে ট্রাকে করে আগরতলায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীতে তিনি ভারত চলে যান এবং মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে উপসচিব হিসাবে কাজ করেন। পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে কর্মরত থাকার পরও মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে কাজ করার জন্য পাকিস্তানের সামরিক আদালত তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁকে ১৪ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে।
আকবর আলি খান ১৯৭৩ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ পেয়ে সরকারি চাকরি থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। পদত্যাগপত্রটি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে পৌঁছালে তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারে তাঁর ভূমিকার কথা স্মরণ করে এবং দেশ গড়ার কাজে তাঁর প্রয়োজন আছে উল্লেখ করে পদত্যাগপত্র ফিরিয়ে দেন এবং তাঁকে লিয়েনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের অনুমতি দেন। শর্ত ছিল তিন বছরের মধ্যে তাকে সরকারি চাকরিতে ফিরে আসতে হবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি কমনওয়েলথ শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে পিএইচডির জন্য কানাডা চলে যান এবং সেখান থেকে ফিরে এসে সাত বছর পর সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। চাকরিতে থাকাকালীন অবস্থায় তিনি বাংলাদেশ পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ট্রেনিং সেন্টারে (বিপিএটিসি) প্রায় ৪ বছর পড়িয়েছেন। জীবনের শেষ ১১ বছর তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে যুক্ত ছিলেন। তিনি শিক্ষক হতে চাইলেও আমলা হিসেবেই জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন।
আকবর আলি খান যথার্থ রেফারেন্স ছাড়া কিছু লিখতেন না। তিনি প্লেজিয়ারিজম (কুম্ভিলকবৃত্তি) সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন থাকতেন। তিনি ছাত্রছাত্রীদেরকেও প্লেজিয়ারিজম থেকে সবসময় বিরত থাকতে বলতেন। তিনি সময় সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। ক্লাস শুরুর ৫ মিনিট পূর্বে তিনি শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত থাকতেন। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ বা এক্সিকিউটিভ এমবিএ প্রোগ্রামের ক্লাসগুলো ৩ ঘন্টা করে হয়ে থাকে। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও ৭৮ বছরের আকবর আলি খান পুরো ৩ ঘন্টা ধরেই পড়াতেন। মাঝখানে ১৫ মিনিট চা পানের জন্য বিরতি দিতেন। রমজান মাসে রোজা রেখেও তিনি পূর্ণসময় লেকচার দিতেন। তাঁর সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় কনফারেন্স, মিটিং বা সেমিনারে গিয়েছি। তিনি নির্দিষ্ট সময়ের আগে উপস্থিত থাকতেন। অনেক সময় যানজটে স্যারের সাথে গাড়িতে বসে থাকতে হয়েছে। যানজট নিরসনে তিনি ঢাকাকে ডিসেন্ট্রালাইজেশনের (বিকেন্দ্রীকরণ) কথা বলতেন।
আমি যখন ২০১৮ সালে আকবর আলি খানের সাথে কাজ শুরু করি, তখন তিনি বলেছিলেন তিনি জীবদ্দশায় আরো আটটি বই শেষ করে যেতে যান। তখন তাঁর বয়স ছিল ৭৩ বছর। তিনি বেঁচে থাকলে ৮০ বছর (২০২৫ সাল) বয়সের মধ্যে বইগুলো শেষ করতে চেয়েছিলেন। আকবর আলি খানের সাথে তাঁর শেষ পাঁচটি বইতে আমার কাজ করা হয়েছিল এবং সবগুলো বই প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়। আমার কাজ ছিল মূলত তথ্য সংগ্রহ, সারণি প্রস্তুতকরণ, রেখাচিত্র অঙ্কন, পরিশিষ্টের তথ্যাদি প্রস্তুতকরণ ইত্যাদি। ২০১৯ সালে তাঁর দুইটি বই প্রকাশিত হয়। একটি দুর্ভাবনা ও ভাবনা: রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এবং অন্যটি বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য: একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ। ২০২০ সালে প্রকাশিত হয় দারিদ্র্যের অর্থনীতি: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। ২০২১ সালে বাংলাদেশে বাজেট: অর্থনীতি ও রাজনীতি এবং ২০২২ সালে তাঁর সর্বশেষ বই, তাঁর আত্মজীবনী (প্রথম খণ্ড) পুরানো সেই দিনের কথা প্রকাশিত হয়। আকবর আলি খান সবগুলো বইয়ের ভূমিকাতে আমার নাম উল্লেখ করেছেন এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। যেমন দারিদ্র্যের অর্থনীতি: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বইয়ের ভূমিকাতে তিনি লিখেছেনঃ
“ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় রিফাত হাসানকে আমার শিক্ষকতা সহকারী হিসেবে নিযুক্ত করে। রিফাত হাসান এই বইয়ের রেখাচিত্রগুলো এঁকে দেন এবং পরিশিষ্টের তথ্যাদি প্রস্তুত করেন। আমি তাঁর কাছে গভীরভাবে ঋণী। ”
বই প্রকাশ হওয়ার পর তিনি অটোগ্রাফসহ একটি করে বই আমাকে উপহার হিসেবে দিতেন। তিনি আরো তিনটি বই শেষ করে যেতে চেয়েছিলেন। এদের মধ্যে একটি হচ্ছে তাঁর আত্মজীবনী (দ্বিতীয় খন্ড)। বাকি দুইটির মধ্যে একটি বাংলাদেশের ইতিহাস বিষয়ক, অন্যটি বাংলাদেশের পানি সম্পদ নিয়ে। আকবর আলি খান তাঁর আত্মজীবনী প্রথম খণ্ডে জীবনের প্রথম ২৯ বছরের (১৯৭৩ সাল পর্যন্ত) ঘটনাবলি বর্ণনা করেছেন। দ্বিতীয় খণ্ডে তিনি ১৯৭৩ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত লিখতে চেয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশের তিনটি সরকারের অধীনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। সেসব অভিজ্ঞতা লিখার ইচ্ছা ছিল দ্বিতীয় খণ্ডে। তিনি বলেছিলেন, দ্বিতীয় খণ্ডে সরকারের অনেক গোপন তথ্য প্রকাশিত হতে পারে। তিনি তাঁর অবর্তমানে আত্মজীবনী দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশের কথা চিন্তা করেছিলেন।
আকবর আলি খান ১৭টি বই প্রকাশ করেছেন (বাংলায় ১০টি, ইংরেজিতে ৭টি)। এছাড়া তিনি সম্পাদনা করেছেন ২টি বই। তাঁর প্রতিটি বই দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা এবং গবেষণার ভিত্তিতে রচিত। তিনি পানি সম্পদ নিয়ে যে বই লিখতে চেয়েছিলেন, সেটি নিয়ে তিনি প্রায় ৪০ বছর ধরে চিন্তাভাবনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে রচিত দুর্ভাবনা ও ভাবনা: রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখার জন্য তিনি প্রায় ৫৮ বছর ধরে ভেবেছেন। বাংলায় ইসলাম প্রচার নিয়ে গবেষণা করেছেন ২৯ বছর ধরে। প্রকাশের পর বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য: একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ বইটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং আসামের ২৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ডাকযোগে পাঠিয়েছেন গবেষক এবং আগ্রহী ছাত্রছাত্রীদের পড়ার জন্য। তবে আকবর আলি খান লেখার চেয়ে পড়তে বেশি ভালোবাসতেন। তিনি প্রতিবছর একুশে বইমেলার সময় বইয়ের লম্বা একটি তালিকা আমাকে দিতেন। আমার বইমেলাতে যাওয়ার তেমন অভ্যাস না থাকলেও স্যারের সাথে কাজ করার সময় প্রতিবছর বই সংগ্রহ করার জন্য বইমেলায় যেতে হয়েছে। এছাড়া তাঁর গবেষণার জন্য ঢাকার বিভিন্ন গ্রন্থাগার থেকে অনেক দুষ্প্রাপ্য বই সংগ্রহ করতে হয়েছে। অনেক বই দেশের বাইরে থেকে সংগ্রহ করেছি। তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে পাঁচ হাজারের বেশি বইয়ের সংগ্রহ ছিল। মৃত্যুর কয়েকমাস আগে তিনি প্রায় সবগুলো বই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়েশা আবেদ লাইব্রেরিতে দিয়ে যান। বর্তমানে গ্রন্থাগারটিতে তাঁর নামে একটি কর্নার স্থাপন করা হয়েছে।
আকবর আলি খানের পরিবারে কেউ ছিলেন না। তাঁর একমাত্র মেয়ে ২০১৬ সালে এবং স্ত্রী ২০১৭ সালে মারা যান। বৃহস্পতিবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, যেদিন রাতে আকবর আলি খান মারা যান, সেদিন সন্ধ্যায় তাঁর সাথে আমার ফোনে সর্বশেষ কথা হয়। তখন তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামার ২০২২ সেমিস্টারের এমবিএ প্রোগ্রামের বিজনেস এনভায়রনমেন্ট কোর্সের ফাইনাল পরীক্ষার খাতা দেখছিলেন। তিনি বলেছিলেন তাঁর আরো ১৩টি খাতা মূল্যায়ন করা বাকি আছে এবং আমাকে শনিবারে তাঁর বাসায় গিয়ে খাতাগুলো নিয়ে আসতে বলেছিলেন। সেদিন রাত ১০টার দিকে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। পরবর্তীতে আমি যখন পরীক্ষার খাতাগুলো নিয়ে আসি, তখন গুনে দেখি আরো ১০টি খাতা মূল্যায়ন করা বাকি আছে। অর্থাৎ সেদিন সন্ধ্যায় স্যার আমার সাথে কথা বলার পরও আরো ৩টি খাতা দেখেছিলেন। তিনি কয়েকদিন থেকে কিছুটা অসুস্থ বোধ করছিলেন। কিন্তু তিনি এভাবে হঠাৎ করে চলে যাবেন এটা হয়ত তিনি নিজেও বুঝতে পারেননি। তাঁর গুলশানের বাসায় আমার নিয়মিত যাতায়াত হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে, প্রকাশনার কাজে, গবেষণার কাজে, অথবা অন্য যে কোন কাজেই যাওয়া হোক না কেন, প্রথমে স্যারের সাথে চা-নাশতা খেতে হতো, তারপর আমাদের কাজ শুরু হতো। আকবর আলি খানের জীবনের শেষ পাঁচটি বছর আমি তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। তিনি ছিলেন একজন স্পষ্টবাদী মানুষ, ছিলেন একজন দক্ষ গবেষক এবং লেখক। তিনি তাঁর লেখায় অর্থনীতি, ইতিহাস, রাজনীতি এবং সাহিত্য সব বিষয়েই দেখিয়েছেন পাণ্ডিত্য। তিনি আর কয়েকটা বছর বেঁচে থাকলে হয়তো অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করে যেতে পারতেন।
A condensed version of the article was published in the Daily Amader Shomoy on September 8, 2023.

